ব্যাপক তোলপাড় ব্রিটিশ রাজপরিবারে, চরম চাপের পর জরুরি বৈঠক

আন্তর্জাতিক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক।
০৯:০৬:৫০পিএম, ৯ মার্চ, ২০২১

ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেল রাজপরিবারের বর্ণবাদী চেহারা ফাঁস করার পর সেখানে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন টিভি চ্যানেল সিবিএস-এ আলোচিত সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচারের পর তোলপাড় হওয়ায় চরম চাপে পড়ে জরুরি বৈঠক করেছে রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ করতে এ বৈঠক হয়। প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান যে অভিযোগ তুলেছেন তা নিয়ে চুপ করে থাকাটা বাকিংহাম প্যালেসের জন্য অনেক কঠিন হলেও কিছু বলার ক্ষেত্রে তারা তাড়াহুড়া করতে চাইছে না বলে ব্রিটিশ সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন।

ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারির স্ত্রী মেগান মার্কেল মার্কিন সিবিএস টেলিভিশনের অপরা উইনফ্রে’র সঙ্গে রোববারের সাক্ষাৎকারে রাজপরিবারের বর্ণবাদী আচরণ সম্পর্কে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, অনাগত সন্তানের ত্বকের রং কেমন হবে তা নিয়েও রাজপরিবারের সদস্যরা তাকে কথা শুনিয়েছেন।

তবে কারা এমন কথা বলাবলি করছিলেন সে বিষয়টি প্রকাশ করেননি মেগান।

গার্ডিয়ান জানায়, বরিস জনসন এই বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে কোনো রেখা টানতে রাজি হননি। তবে রাজপ্রাসাদের অভিযোগগুলোর তদন্ত করা উচিত কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী ডাউনিং স্ট্রিটে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সম্ভবত আমি সবচেয়ে ভালো বলতে পারি যে, রানীর প্রতি আমার সর্বদা প্রশংসা ছিল এবং তিনি আমাদের দেশ ও কমনওয়েলথ জুড়ে যে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটার জন্য। রাজপরিবারের সাথে অন্যান্য সমস্ত কাজ করার জন্য, আমি এখন রাজপরিবারের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।

তবে ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টিতে বরিস জনসনের সহকর্মী এবং সরকারী মন্ত্রী জ্যাক গোল্ডস্মিথ দাবি করেছেন, হ্যারি তার পরিবারের প্রশংসা করে যে টুইট করেছিরেন তাতে বলা ছিল, ‘মেগান যা চায়, সে তাই-ই পায়।’

ব্রিটিশ ছায়া শিক্ষা সচিব কেট গ্রিন স্কাই নিউজকে এই দম্পতির দাবির বিষয়ে বলেছেন, ‘সত্যই দুঃখজনক, মর্মস্পর্শী’ এবং রাজপ্রাসাদকে বর্ণবাদের যেকোনও অভিযোগ তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন। গত সপ্তাহে মেগানের বিরুদ্ধে এক প্রাসাদ কর্মীর অভিযোগের তদন্ত শুরু করেছে রাজপ্রসাদ।

ব্রিটিশ লেবার নেতা কায়ার স্টারমার বলেছেন, মেগানের উত্থাপিত বর্ণবৈষম্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অভিযোগগুলো ‘রাজপরিবারের চেয়ে বড়’ এবং তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা উচিত নয়। দেশটির শিশু বিষয়ক মন্ত্রী ভিকি ফোর্ড জোর দিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে বর্ণবাদের কোনও স্থান নেই’।

সাক্ষাৎকারের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সোসাকি বলেছেন, মানসিক বিষয়ে নিজের সংগ্রাম সম্পর্কে কথা বলার জন্য মেগানের ‘সাহস’র প্রশংসা করেন বাইডেন। তবে সোসাকি বলেছেন, ‘এগুলো ব্যক্তিগত নাগরিকদের দেওয়া তথ্য ও তাদের নিজস্ব গল্প এবং তাদের সংগ্রামী জীবন ভাগাভাগি করে নেওয়ার’ বিষয়ে তিনি অতিরিক্ত মন্তব্য করবেন না।’

রাজকীয়দের জীবনী লেখক পেনি জুনার বলেছেন, এই দম্পতি ‘পরিবারে একটি হাত গ্রেনেড রেখেছিলেন’ এবং আশঙ্কা করেছিলেন যে, তারা ‘আর ফিরে আসবে ন ‘।

রাজকীয় লেখক এবং ইতিহাসবিদ রবার্ট লেই বলেছেন, এই প্রতিক্রিয়াগুলো ‘দীর্ঘ সময়ের জন্য পুনরায় সংঘবদ্ধ হবে, কারণ এগুলো ব্যক্তিত্বের চেয়ে বেশি। এটি একটি অকার্যকর পরিবারের বিষয়ে প্রথম সাক্ষ্য।’

ম্যাজেস্টি ম্যাগাজিনের চিফ-ইন-চিফ, ইনগ্রিড সেওয়ার্ড বলেছেন, ‘এটি সম্ভবত রাজ পরিবারের সবচেয়ে আপত্তিজনক নিন্দা এবং তারা এই পরিবার কীভাবে পরিচালনা করে আমি কখনও শুনিনি।’

তবে রানির সাবেক প্রেস সেক্রেটারি চার্লস আনসন স্কাই নিউজকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি রাজপ্রাসাদ এই সাক্ষাত্কারের প্রতিক্রিয়া দেখানোর চেষ্টা করবে এবং কিছু বিষয়কে সামনে নিয়ে যাবে যেটা বিষয়গুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলবে না ও এর ফলে কিছুটা পুর্নমিলনও হতে পারে।’

রাজতন্ত্রবিরোধী গোষ্ঠী রিপাবলিকরা রাজতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে একটি সৎ বিতর্কের আহ্বান জানিয়েছে এবং বলেছে যে, এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে ‘যাওয়া দরকার’।

সোসাইটি অফ এডিটর্স ও যুক্তরাজ্যের প্রেসগুলোকে গোঁড়া দাবি করে কেউ কেউ আক্রমণ চালালে এর নির্বাহী পরিচালক আয়ান মারে বলেছেন, ‘যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গোঁড়া নয় এবং ধনী ও শক্তিশালীকে জবাবদিহিতায় রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হবে না।’

তবে তিনি যোগ করেছেন যে, প্রমাণ ছাড়াই এ জাতীয় দাবি করা ‘গ্রহণযোগ্য নয়’।

এর আগে মেগান বলেন, রাজতন্ত্রের অভ্যন্তরে বর্ণবাদ রয়েছে। মেগান বলেন, মানসিক সংকটের সময় তাকে সাহায্য করতেও অস্বীকৃতি জানানো হয়, মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয় এমনকি তার অনাগত সন্তানের ত্বকের রং নিয়েও রাজপরিবারে উদ্বেগ ছিল। তিনি বলেন, তাকে বলা হয়েছিল ত্বকের রংয়ের কারণে তার সন্তান আর্চি-কে রাজকীয় খেতাব দেওয়া হবে না।

নিজে গর্ভবতী থাকার সময়ে ট্যাবলয়েড আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন আলাপচারিতা নিয়ে নিজের ওপর প্রভাব সম্পর্কে মেগান বলেন, ‘আমার শুধু মনে হয়েছিল আর বাঁচতে চাই না। আর সেটা খুব স্পষ্ট ও বাস্তব এবং ভীতিকর চিন্তা ছিলো।’ আত্মহত্যার চিন্তা করেছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মেগান বলেন, ‘হ্যাঁ। সেটা খুব স্পষ্ট চিন্তা ছিলো।’

প্রিন্স হ্যারি ও মেগান মার্কেল অনেক আগেই রাজকীয় দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন এবং আমেরিকায় বসবাস করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।

শ্বেতাঙ্গ বাবা আর কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান মেগান মার্কেল ওই সাক্ষাৎকারে রাণীকে সরাসরি অভিযুক্ত না করলেও ক্রাউন প্রিন্সসহ অন্যদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

মেগান বলেন, আমার অন্তঃস্বত্ত্বার কয়েক মাসে ঘুরে ফিরে কয়েকটি কথায় আসতো- তুমি রাজকীয় নিরাপত্তা পাবে না, কোনো রাজকীয় খেতাবও পাবে না। আর যখন ওর জন্ম হবে, ওর গায়ের রঙ কতটা কালো হতে পারে তা নিয়েই তাদের যত উদ্বেগ ছিল।

ব্রিটেনে কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে অমানবিক আচরণের বহু অভিযোগ রয়েছে। এখন রাজপরিবারেও বর্ণবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে বলে মেগানের মাধ্যমে স্পষ্ট হলো।

সূত্র: গার্ডিয়ান